ট্রাম্প না বাইডেন, কার হাতে যাবে জয়ের লাটাই

ডোনাল্ড ট্রাম্প, জো বাইডেন

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশ্বের একজন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। মহামারি, যুদ্ধ কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো যেকোনো আন্তর্জাতিক সংকটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কী ভূমিকা রাখবেন, সেদিকেই দৃষ্টিপাত রাখে গোটা বিশ্ব। সে কারণেই চার বছর পরপরই যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সন্নিকটবর্তী হয়, তখন এর ফলাফল কী হতে পারে, তা নিয়ে গোটা বিশ্বের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আগামী ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ এ নির্বাচন। আমেরিকার আসন্ন এ নির্বাচন ঘিরে চলছে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা, সৃষ্টি হচ্ছে নানা জল্পনা-কল্পনার। গুরুত্বপূর্ণ এ নির্বাচনে কে হতে যাচ্ছেন বিশ্বমোড়ল? আমেরিকার ভোটাররা কি হোয়াইট হাউসে দ্বিতীয় মেয়াদে আবার ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চাচ্ছেন, নাকি ক্ষমতার পালাবদল ঘটে জো বাইডেনের হাত ধরে নতুন শক্তিকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন?

গণতন্ত্রের বাতিঘর হিসেবে খ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনে এবার রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে টক্কর দিচ্ছেন ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেন। জো বাইডেন গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে যুক্ত আছেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি বেশ পরিচিত। আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী প্রচারের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো জনমত জরিপ। জনপ্রিয়তায় শীর্ষে কোন প্রার্থী কতটা এগিয়ে আছেন, সে বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে পরিচালিত জরিপ থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জনমত জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। এতে পরিষ্কার ব্যবধানে এগিয়ে আছেন জো বাইডেন। অন্যপক্ষে ট্রাম্প কোনো রকমে নিজের অবস্থান ধরে রাখতেও হোঁচট খাচ্ছেন।

মার্কিন নির্বাচনী বিশ্লেষকেরা, অতীতের ভোট দেওয়ার গতিপ্রকৃতি, এ মূহুর্তে ভোট দেওয়ার হার, জনমিশ্রণের অনুপাত এবং ভোটারদের পরিবর্তনশীল মনোভাব বিবেচনায় নিয়ে অ্যারিজোনা, ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, মিশিগান, মিনেসোটা, নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিন—আটটি অঙ্গরাজ্যকে মূল ব্যাটল গ্রাউন্ড হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁরা মনে করছেন, এসব অঙ্গরাজ্যের ফলাফলের ওপরই নির্ভর করছে হোয়াইট হাউস কার দখলে যাচ্ছে। জনমত জরিপে এ ৮ অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ৭টিতেই ৭ থেকে ৯ পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে বাইডেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, এনবিসি ও টেলিমুন্দোরের জনমত জরিপেও দেখানো হয়েছে জো বাইডেন এগিয়ে আছেন। টুগেদার নামের প্রতিষ্ঠানটির জরিপে নারীদের মধ্যে বাইডেন এগিয়ে আছেন ১১ পয়েন্টে আর পুরুষদের মধ্যে ট্রাম্প এগিয়ে আছেন ৭ পয়েন্টে। এরই মধ্যে আগাম ভোট দেওয়ার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তাতে ডেমোক্র্যাটের সমর্থকেরা এগিয়ে আছেন। একটি গণমাধ্যমের হিসাব অনুযায়ী, ৪২ অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের ভোট দেওয়ার অনুপাত ২: ১।

সিএনএন, এসএসআরএস এবং ফক্স নিউজ পরিচালিত প্রতিবেদনে ৫০ শতাংশের বেশি লোক বাইডেনকে সমর্থন জানিয়েছেন, বিপরীতে ট্রাম্পকে ৪৩ শতাংশ। ট্রাম্পের পিছিয়ে পড়ারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। জাতিগত বিদ্বেষী মনোভাবের কারণে হিস্পানিক জাতিগোষ্ঠী তার প্রতি ক্ষুব্ধ। এতে হিস্পানিক অধ্যুষিত এলাকায় ট্রাম্প পিছিয়ে পড়তে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফ্লোরিডায় ২০ শতাংশ, টেক্সাসে ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ, নেভাদারে ২৯ দশমিক ২ শতাংশ এবং অ্যারিজোনায় ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ হিস্পানিক জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। এ বিপুলসংখ্যক হিস্পানিক ভোটারই বেশির ভাগ অঙ্গরাজ্যে জয়-পরাজয় নির্ধারণে তাৎপর্য ভূমিকা পালন করেন। এসব কারণে ৩ নভেম্বর নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাগ্য নিয়ে নানা মন্তব্য করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে এসব জরিপ ও আগাম ভোট বিবেচনায় এগিয়ে থাকা মানে এই নয় যে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীই বিজয়ী হবেন। এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণাই এমন ইঙ্গিত দেয় না যে আগাম ভোটে এগিয়ে থাকলেই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া যায়। এসব জরিপ থেকে নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে আগে থেকে আন্দাজ করা বেশ কঠিন। কেননা, ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ও নির্বাচনের আগে জাতীয় পর্যায়ে জনমত জরিপে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন ৩০ লাখ ভোটে এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যায়ে তিনি পরাজিত হন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রচারণার সময় ট্রাম্পের ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমণাত্মক ভঙ্গি, উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী বিদ্বেষ ছড়ানোর অস্ত্র কাজে লাগিয়ে সুকৌশলে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তবে চার বছরের আগের প্রেক্ষাপট এখন আর নেই। গত সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে দেশজুড়ে নানা বিভ্রান্তিকর বিবৃতি ও কর্মকাণ্ডের জন্য প্রবলভাবে নিন্দিত ও সমালোচিত হন। বিশেষ করে, বর্তমান করোনা পরিস্থিতে ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন মোকাবিলায় তাঁর কট্টর সমর্থকদের মধ্যেও হতাশার ছাপ দেখা দিয়েছিল। এ ছাড়া স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং আয়কর ইস্যু নিয়েও জনগণের মধ্যে অসন্তোষ আছে। এরই মধ্যে নিজ দলেই ট্রাম্পের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। নির্বাচনী বাতাস বিরুদ্ধে যাচ্ছে টের পেয়ে রিপাবলিকান পার্টির অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা নিজেদের আনুগত্য পরিবর্তন করে নিচ্ছেন বলেও জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে এরই মধ্যে অনেক আমেরিকানের মধ্যে এটাও প্রতিয়মান হয়েছে যে ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় এলেও দেশের তেমন কোনো অর্থবহ পরিবর্তন আসছে না।

করোনার কারণে চাকরি হারানো, বেতন কমে যাওয়া এবং মার্কিনি চেক না পাওয়ার জন্য ডেমোক্র্যাটরা দায়ী বলে অনেক আমেরিকান মনে করছেন। সে জন্য আগামী নির্বাচনে এসব ইস্যু কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে। তা ছাড়া সাধারণ আমেরিকানদের এক-চতুর্থাংশ এ নির্বাচন নিয়ে ভাবেন না। ভোটকেন্দ্রে অনেকে ভোটও দেন না। যে দল এসব নীরব ভোটারকে কেন্দ্রে বেশি টানতে পারবে, তাঁর জয়ের সম্ভাবনা বেশি থাকবে।

দাবার এ ঘুঁটিকে হাতে আনার জন্যই ট্রাম্প অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন রাজ্যে সমাবেশ করছেন। ২০১৬ সালে যেমন নির্বাচনের শেষ সপ্তাহে ভোটারদের অনুপ্রাণিত করে কেন্দ্রে আনতে পেরেছিলেন, এবার এমনটাই আশা করছেন তিনি। আর আমেরিকা নির্বাচনের শেষ সপ্তাহেই মোটামুটি নির্ধারিত হয়ে যাবে হোয়াইট হাউস কার দখলে যাচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্প তাঁর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে পারবেন কি আবার বিশ্বমোড়ল হতে? নাকি ক্ষমতার লাটাই যাবে জো বাইডেনের হাতে? এ জন্য আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত।


*শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]