চড়ুইভাতি

নিত্যপ্রয়োজনীয়! কথাটা বোধ হয় দ্রব্যাদির ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করা হয়। ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা, সহনশীলতা এসবও যে নিত্যপ্রয়োজনীয়। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আজকাল আকাশচুম্বী। ভালোবাসার, শ্রদ্ধাবোধের, সহমর্মিতার, সহনশীলতার ক্ষেত্রেও তাই। খুব সহজে মিলছে কই? পাঁচজন বন্ধু কিংবা সহপাঠী একসঙ্গে হলে গল্প রেখে ফোন ঘাঁটতেই যেখানে ব্যস্ত হই আমরা! সেখানে বড় পরিসরে রান্নাবান্না, আড্ডা, গান, খেলাধুলার আয়োজন যেন একটু কঠিনসাধ্য ব্যাপারই। করোনা–পরবর্তী সময়ে এসে খুব অল্প সময়ে অধিক পরিমাণে পরীক্ষার চাপ ঘিরে আছে সবাইকে। সেশনজট কাটিয়ে উঠতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দম ফেলার ফুরসতই পাচ্ছেন না। তবে আমরা বোধ হয় পারি ‘কাঠিন্যকে ভালোবাসিতে, জয় করিতেও।’ আজকে বোধ হয়ের গল্প নয়, বাস্তবে একটা হৃদ্যতাপূর্ণ আয়োজনের গল্প বলব। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের চড়ুইভাতি আয়োজনের গল্প।

চড়ুইভাতি—গুগল বলছে নানান পাখির কিচিরমিচির ছন্দে দল বেঁধে প্রাকৃতিক পরিবেশে রান্নাবান্না করে খাওয়া, আনন্দ, হৈ-হুল্লোড় করা। আমাদের আয়োজনও ঠিক তেমনি। সেটার জন্য বার দুয়েক তারিখ ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু ঠিক জুতসই হচ্ছিল না। ক্লাস, পরীক্ষার চাপ থেকে কিঞ্চিৎ মুক্তি পেতে কেউ কেউ বাড়ি ছুটছিল। তাই ব্যাটে বলে হয়ে উঠছিলও না। তবে সেটা সম্ভবপর হয়েছে নতুন বছরে এসে। চূড়ান্ত হলো ৬ তারিখই হোক তবে আমাদের চড়ুইভাতির তারিখ। সে অনুসারে একটা নির্দিষ্ট করা চাঁদা সংগ্রহ করা। অতঃপর খাবারের কী কী পদ হতে পারে? রান্নার কাজ কীভাবে এগোবে? সাউন্ড সিস্টেম, খেলাধুলা কী কী থাকছে? ক্যাম্পাসের কোন স্থানে আয়োজন করলে সবচেয়ে ভালো হয়? এতসব আলোচনার টেবিলে নিয়ে বসে যাই মোটামুটি সবাই। সবকিছু গুছিয়ে বাজারের পালা। মুদিপণ্যের দোকানে দাঁড়িয়েও নতুন করে আরও বন্ধুদের সংযুক্তির খবর স্বস্তি এনে দিচ্ছিল বারবার। তাদের ছাড়া পুরো অনুষ্ঠান কি আসলেই পূর্ণতা পেত, মোটেও না।

আলোচনার টেবিলের সব খবর বলে দেওয়া যায় না। তবে সবচেয়ে সহজে বলে ফেলা কঠিন কাজটা না বললেই নয়। সেটি? ‘নিজেরাই রান্না করব।’ কিন্তু! কেউ পেশাদার বাবুর্চি নই। আবার কেউ কখনো বন্ধুবান্ধবদের ছোট ঘরোয়া আয়োজনের রান্নার চেয়ে বেশি পারদর্শী নই। তবে এটাই সবচেয়ে মজার ব্যাপার হবে ধরে নিয়ে নিজেরাই দক্ষ বাবুর্চির ঢঙে বাজারের লিস্ট সাজিয়েছি। যথারীতি সে অনুসারে বাজার করে নিয়ে আসা হলো। পোলাওয়ের চাল, ডাল, ডিম, পানীয় , মসলাপাতি, সালাদের জন্য বেশ কিছু পদ।

কিন্তু জ্বালানি কাঠই যে পাওয়া গেল না! কী উপায়? চলো খুঁজি ক্যাম্পাসের এখানে–ওখানে। তাতে যে পরিমাণ লাকড়ি পাব, তাতে হয়তো আমাদের রান্না হয়ে যাবে। কিন্তু তাতে আসলে কি হয়েই যায়? কিছু লাকড়ি ‘লালন শাহ হল’ ম্যানেজার মারফত জোগাড় করা হলো। আসল চ্যালেঞ্জ কিংবা আমাদের আয়োজনের সব ব্যাপার, মানে ৬ তারিখের সবকিছু।

শীতের সকালে কুয়াশা ভেদ করে সুয্যি মামা উঁকি দিতে দিতে সকাল ১০টা। কিন্তু তৎক্ষণ কি বসে থাকা যায়? সকাল আটটায় সবাই কাজে লেগে যাই। হরেক পদের মসলা প্রস্তুত করে কোনো কোনো পদ পেস্ট করতে হবে। কিন্তু এত পরিমাণে সেসব করাটা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সেটাও সহজ হয়ে গেল আমাদের বিবাহিত বন্ধু জুবায়েরের কল্যাণে। রোস্টের জন্য মুরগি কিনে নিয়ে এসে থেকে শুরু হয় আমাদের রান্নার যুদ্ধ। এ সময়ে সবাই হয় বাবুর্চি, নয় সহযোগীর ভূমিকায়। অনেক নাম! ধরে ধরে বলতে গেলে বিশাল এক তালিকা বনে যাবে। রান্নার কাজে সবার আন্তরিক অংশগ্রহণ সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার ছিল। শাওন, সুমন, এশা, জেরিন, রাসেল, প্রিয়া, আনিচ, মঈনুল, আজাদ, কাইউম, হুমায়ূন আরও কত নাম! রান্নার কাজের ফাঁকে কিছু বন্ধু কুপন হাতে র‍্যাফল ড্র আয়োজন করতে কুপন বিক্রিতে ব্যস্ত। কেউ সাউন্ড সিস্টেমে পছন্দের গান বাজাতে, নাচ করতে, ছবি তুলতে ব্যস্ত। স্বকণ্ঠে গান গেয়ে আনন্দ দেওয়াদের তালিকায় মেহেদী, পূজা, নিবিড় অন্যতম।

রান্না শেষ হতে হতে বেলা তিনটা। সবাই অনেক ক্ষুধার্ত। জম্পেশ খাওয়া, নিজেদের রান্নার প্রশংসাকারীও আমরা নিজেরাই। খাওয়া শেষে খানিক জিরিয়ে, গল্প করে খেলাধুলা আর র‍্যাফল ড্রর পালা। সবাই একসঙ্গে গোল হয়ে বসে ‘সতিনের ছেলে কেউ নেয় না কোলে’ নামের একটা খেলা খেলেছি। একটা বড় খালি বোতলকে একটা গান বাজার সময়ে একে অপরের দিকে পাস করে করে শেষে যার হাতে গিয়ে গান শেষ হচ্ছে, সে উঠে যাবে। এভাবে খেলা এগিয়েছে। টানটান উত্তেজনা আর আনন্দে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হয়েছে যথাক্রমে সাকিব, বন্যা, নিলয়। এর পরের আয়োজন ‘অন্ধের হাঁড়ি ভাঙা’। চোখে কাপড় বেঁধে একটা নির্দিষ্ট দূরের হাঁড়ি লাঠির আঘাতে ভেঙে ফেলার একটা চাতুর্যপূর্ণ খেলা। নাঈম এ প্রতিযোগিতায় একমাত্র হাঁড়ি ভাঙতে সক্ষম। শীতের দিনের পরিধি কমই, তাই যথারীতি সময়স্বল্পতায় পেয়েছে আমাদের। আমাদের সর্বশেষ আয়োজন, র‍্যাফল ড্র। ১৫ জনকে এখানে নির্বাচিত করা হয় যথেচ্ছাচারে। সবার অংশগ্রহণে বেশ কিছু গ্রুপ ছবিও তোলা হয়। এরপরই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় আয়োজনের সমাপ্তি।

তবে সারা দিনের আনন্দ শেষ হয়েও যেন হইল না শেষ। আয়োজনের প্রান্তে ছিল কিছু আক্ষেপ। সে আক্ষেপ আরও আনন্দ করতে না পারার, সময়স্বল্পতার। তবে প্রাপ্তির কথায় আসা যাক। এই যে নিত্যপ্রয়োজনীয়! ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা, সহনশীলতার পাঠ আমরা একটি দিনের জন্য হলেও খুব ভালোভাবে পাস করতে সক্ষম হয়েছি। আমার বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। যাদের অংশগ্রহণ ছাড়া সার্থক হয়ে উঠত না এই আয়োজন।

লেখক: মঈনুল হক খান, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়