‘গোল্ডেন’ মনিরদের বিরুদ্ধে অব্যাহত থাকুক অভিযান

অর্থনীতি একটি দেশের প্রধান চালিকা শক্তি। একটি দেশের সার্বিক উন্নতি, সমৃদ্ধি নির্ভর করে সে দেশের অর্থনীতির স্বচ্ছতার ওপর। কিন্তু যখন দেশের অর্থনীতিতে অস্বচ্ছতা ঢুকে যায়,‌ চোরাকারবারিদের জালে যখন অর্থনীতির সৌভাগ্য আটকে যায়, তখন দেশের সার্বিক উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়। চোরাচালান বা চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্যের ফলে দেশের অর্থনীতির রাজস্ব আয়ের কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে অকল্পনীয় ক্ষতি হচ্ছে আমাদের অর্থনীতির, ঘুরছে না অর্থনীতির পরম সৌভাগ্যের চাকা।

আমরা সাধারণত মনে করে থাকি যে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য, সোনা,  জনস্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর দ্রব্যাদি, যেমন মাদক বা সাপের বিষের ন্যায় ভয়ংকর এমন কিছু আনা-নেওয়া করাকে ‘চোরাচালান’ বলা হয়। কিন্তু ‘দ্য কাস্টমস অ্যাক্ট-১৯৬৯’ মোতাবেক চোরাচালানের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা রয়েছে।

দেশে কার্যকর আইনগুলোর মধ্যে কেবল কাস্টমস আইনেই ‘চোরাচালান’ বিষয়টি সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ফলে অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা মূলত কাস্টমস আইনের ভিত্তিতেই দেশব্যাপী চোরাচালান নিরোধ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এ আইনে চোরাচালান বলতে যেকোনো পণ্য তার ওপর আরোপযোগ্য শুল্ককর পরিশোধ ব্যতিরেকে আমদানি করাকে বোঝায়। তদুপরি বেশ কিছু আইটেম, যেমন মাদকদ্রব্য, নেশাজাতীয় ওষুধ বা সাইকোট্রপিক বস্তু, সোনা ও রুপার বুলিয়ন, প্লাটিনাম, প্যালেডিয়াম, রেডিয়াম বা বহু মূল্যবান প্রস্তুরাদিও এর অন্তর্ভুক্ত। এ ছাড়া শর্তযুক্ত বা অবাধে আমদানিযোগ্য পণ্যও যদি জাহাজ, নৌযান, উড়োজাহাজ, ব্যাগেজ বা দেহের কোথাও লুকিয়ে পরিবহন করা হয়; অর্থাৎ আরোপনীয় যথাযথ শুল্ককর পরিশোধ ব্যতিরেকে আনা হয়, তা–ও চোরাচালান বলে গণ্য হবে।

এটা বলা বাহুল্য যে চোরাচালান কখনো এককভাবে সংঘটিত হয় না, এর পেছনে একটি বিশেষ চক্র ক্রিয়াশীল থাকে। কেননা বিদেশ থেকে কোনো পণ্য চোরাচালানের মাধ্যমে আনতে গেলে বিপুল পরিমাণ অর্থ‌ ও অভ্যন্তরীণ বিশেষ ক্ষমতাবলয়ের সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে। এই অর্থ দেশের ভেতরের নানা উৎস থেকে হুন্ডি, পণ্য আমদানির নামে ওভার ইনভয়েসিং, মিসডিক্লারেশন বা অন্য উপায়ে পাচার করা হয়। অর্থাৎ চোরাচালান কার্যক্রমের সঙ্গে অর্থ পাচারের বিষয়টিও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। বারবার বিভিন্ন সময়ে অভিযানে ধরা খাওয়ার পরও থেমে নেই চোরাচালান, বন্ধ হয়নি চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য। দেশে দিন দিন এ চোরাচালানের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েই চলছে।

সম্প্রতি সোনা চোরাচালানিতে ‘গোল্ডেন’ মনির নামের এক মাফিয়ার কর্মকাণ্ড দেশের মানুষকে অবাক করেছে। ২২ নভেম্বর রাজধানীর মেরুল বাড্ডার এক বাড়িতে অভিযান চালিয়ে গোল্ডেন মনির নামের এই মাফিয়াকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তাঁর বাড়ি থেকে বিদেশি অস্ত্রসহ অবৈধ ৬০০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার (আট কেজির বেশি), ১০টি বৈদেশিক মুদ্রা, নগদ ১ কোটি ৯ লাখ টাকা, ৫টি বিলাসবহুল গাড়ি ও নামীদামি ব্র্যান্ডের মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়। তাঁর সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ৫০ কোটি টাকার বেশি। এখন মনির আলোচনায় আসছেন, তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কাপড়ের দোকানের সামান্য সেলসম্যান থেকে মনির কীভাবে গোল্ডেন মনির হয়ে উঠলেন, তা নিঃসন্দেহে ভাবার বিষয়। মনিরের পেছনের মনির কারা! কাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে মনিরেরা সোনা চোরাচালানের মাফিয়া গোল্ডেন মনির হয়ে উঠছেন!

মনিরের জীবনের ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, কাপড়ের দোকানের সেলসম্যান থেকে সোনা চোরাকারবারি ও ভূমিদস্যু হয়ে ওঠা ‘গোল্ডেন’ মনির গাউছিয়া মার্কেটের একটি কাপড়ের দোকানের সেলসম্যান হিসেবে কাজ করতেন। এরপর মৌচাকে একটি ক্রোকারিজের দোকান দেন তিনি। সে সময় লাগেজ চোরাচালান চক্রের সঙ্গে তাঁর যোগসাজশ হয়। এরপর জড়িয়ে পড়েন অবৈধ লাগেজ ব্যবসায়। দেশের বড় চোরাচালানি চক্রের তালিকায়ও মনিরের নাম উঠে আসে। শুধু সোনা চোরাচালানই নয়, ভূমিদস্যুর মাধ্যমে তিনি অসংখ্য প্লটেরও মালিক হয়েছেন। দেশে এমন মনিরের সংখ্যা কম নয়। এখনো অনেক মনির বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করছেন। আর এ মনিররা তো এক দিনে তৈরি হননি!

বিমানবন্দরের অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় মনিরের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট–বলয় তৈরি হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, আবুধাবি, শারজাহ, ওমানের মাসকাট, সৌদি আরবের জেদ্দা, কাতার থেকে আসছে সোনার চোরাচালান। আগের তুলনায় দেশে সোনা চোরাচালান জব্দের সংখ্যা বেড়েছে। একটা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যে পরিমাণ সোনা চোরাই পথে দেশে ঢুকছে, আবার সেগুলো পাচারও হচ্ছে। বৈধ পথে আমদানি ও রপ্তানি হলে সরকারের রাজস্ব খাত আরও মজবুত হতো। কিন্তু এসব চোরাকারবারির কারণে দেশের রাজস্ব খাত এখনো তেমনটা আলোর মুখ দেখতে পারছে না।

দেশে অস্ত্র, মাদক, সোনা ও বিস্ফোরক চোরাচালানের বহু সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যাদের আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রের সঙ্গে রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগসাজশ। দেশে এদের রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এখনই যদি এদের নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তাহলে দ্রুত এই অপরাধ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পোঁছাবে।

সরকার চোরাচালান প্রতিরোধের প্রচলিত আইন সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সংশোধিত আইন অনুযায়ী চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের পর জামিন দেওয়া হবে না। সংশোধিত আইনটি এখনো কার্যকর হয়নি। দেখা যায়, প্রচলিত আইনের ফাঁকফোকরে গ্রেপ্তার হওয়ার পরও চোরাকারবারিরা ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। তাই চোরাচালান প্রতিরোধ আইনটি দ্রুত কার্যকর করা দরকার।

সোনা চোরাচালান দেশের অর্থনীতিতে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রায় প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ অবৈধ সোনা আসছে আকাশপথে। দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে প্রায় প্রতিদিনই এসব সোনা ঢুকছে। মাঝেমধ্যে ছোট চালানগুলো ধরা পড়লেও বড় চালানগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে নিরাপদেই। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় গাড়িতে কিংবা বাড়িতে তল্লাশি করেও পাওয়া যাচ্ছে অবৈধ সোনার বার।

চোরাচালান ও চোরাকারবারিরা দেশ ও দেশের অর্থনীতির জন্য অভিশাপ। চোরাচালান ও চোরাকারবারের ফলে দেশের অর্থনীতির সৌভাগ্যের চাবি চলে যায় এক শ্রেণির দুষ্টু সিন্ডিকেটের হাতে। মাঝখান দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অর্থনীতি এবং সরকারের রাজস্ব খাত। এখনই সময় এর লাগাম টেনে ধরার। আর এ জন্য চোরাচালান‌ প্রতিরোধের প্রচলিত আইন দ্রুত সংশোধন করে চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হবে।

  • লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়[email protected]