কাদম্বিনী থেকে সারা গিলবার্ট পর্যন্ত যত কথা

কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ও সারা গিলবার্ট
ছবি: সংগৃহীত

উপমহাদেশের প্রখ্যাত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ফিরোজা বেগমের বাবাকে তাঁর গ্রামের মানুষেরা প্রশ্ন করেছিলেন বাবা হয়ে কেন মেয়েকে ডাক্তারি পড়তে দিয়েছেন। সেই পঞ্চাশ–ষাট দশকে সমাজের চোখে নারী শিক্ষা, সর্বোপরি চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন ছিল অত্যন্ত গর্হিত ও প্রথাবিরোধী কাজ। সেই গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকজন প্রফেসর ফিরোজা বেগমের বাবাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন এই বলে যে তাঁর মেয়েকে ডাক্তারি পড়িয়ে তিনি পর্দানশিন সমাজের প্রথা ভঙ্গ করেছেন, যা সমাজের অন্যান্য মেয়েরা অনুসরণ করে ‘বিপথগামী’ হতে পারে।

সেই বিজ্ঞ আলোকিত মানুষটি তখন দৃঢ়স্বরে উত্তর দিয়েছিলেন, একজন মেয়ের প্রথা ভঙ্গ করার ফলে যদি শত শত মেয়েদের প্রাণ ও ইজ্জত বাঁচে, সেই চিন্তা থেকেই তিনি তাঁর মেয়েকে ডাক্তারি পড়তে দিয়েছেন।

পরবর্তীকালে তাঁর কথাই সত্যি হয়েছিল। এই প্রফেসর ফিরোজা বেগমের হাতে সেই গ্রামের ও বাংলাদেশের কতশত মেয়েরা যে সুস্থ হয়েছেন, জীবন ফিরে পেয়েছেন, সন্তানের মা হয়েছেন, কত শিশু পৃথিবীর মুখ দেখেছে, তার পরিসংখ্যান নাই–বা দিলাম!

বর্তমানে একটি ভারতীয় টিভি চ্যানেলে সত্য ঘটনা অবলম্বনে পরিবেশিত হচ্ছে ‘কাদম্বিনী’ নামের একটি সিরিয়াল। এটা দেখে কাদম্বিনীকে আবার নতুন করে অনুধাবন করলাম। ১৮৬১ সালে জন্ম নেওয়া কাদম্বিনী গাঙ্গুলি এই উপমহাদেশের প্রথম মহিলা ডাক্তার। তখনকার দিনে ডাক্তারি ভর্তি হতে বা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, পরিবারে ও সমাজে কাদম্বিনীকে যে বাধা ও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, তা হয়তো এই ২০২১–এ দাঁড়িয়ে কল্পনা করার সাধ্য আমাদের নেই। তখন অবিবাহিত মেয়েদের ডাক্তারি পড়া নিষিদ্ধ। কাদম্বিনী বিয়ে করেছিলেন তাঁর শিক্ষক দ্বারকানাথকে, মূলত যাঁর সার্বিক সহযোগিতা ও অণুপ্রেরণা ছাড়া হয়তো কাদম্বিনীর ডাক্তার হওয়া সম্ভব হতো না। সমাজ, সংসার এমনকি শিক্ষকেরাও নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন একজন মেয়ে শিক্ষার্থীর জন্য।

প্রতিনিয়ত কাদম্বিনীকে নিজের পরিবার থেকে শুরু করে কলেজ অবধি নানা রকম বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। যেমন এনাটমি ক্লাসে কাদম্বিনীর ঢোকা ছিল নিষিদ্ধ, পরীক্ষায় ইচ্ছাকৃতভাবে ফেল করিয়ে দেওয়া ইত্যাদি ছিল কয়েকটা উদাহরণ।
মেডিকেল কলেজে প্রথম দিন কাদম্বিনীকে এক শিক্ষক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘মেয়েদের কাজ হচ্ছে ঘর–সংসার করা, বাচ্চা লালন–পালন করা। মেয়েরা কেন ডাক্তারি পড়তে এসেছে?’ কাদম্বিনীও তখন প্রফেসর ফিরোজা ম্যাডামের বাবার মতো একই উত্তর দিয়েছিলেন, ‘মেয়েরা ডাক্তার না হলে আমার বা আপনার মা–বোনদের বাঁচাবে কে?’

উল্লেখ্য, সেই সময়ে মেয়েদের সে যে বয়সেরই হোক না কেন বা যত অসুস্থই হোক না কেন, কোনো পুরুষ ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসাসেবা নেওয়ার অনুমতি ছিল না।

খুব কাছের বান্ধবীকে প্রসূতি–পরবর্তী জটিলতায় শুধু গোঁড়ামি ও অন্ধত্বের জন্য মরে যেতে দেখে কিশোরী কাদম্বিনী পণ করেছিলেন যে তিনি বড় হয়ে ডাক্তার হবেন ও মেয়েরা যেন এভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়। অবশেষে সব বাধা-বিপত্তি পার হয়ে কাদম্বিনী এই উপমহাদেশে স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ করে নারীদের জন্য ত্রাণকর্তা হয়ে আমৃত্যু নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।

বিশ্ব সভ্যতা ও বিজ্ঞান এখন অনেক দূর এগিয়েছে। মানব ইতিহাসে নারীরা কোদাল দিয়ে মাটি কেটে কৃষিবিপ্লবের সূচনা ঘটিয়েছিলেন। এখন নারীদের সেই অগ্রযাত্রা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভাসিত হয়েছে নানাভাবে, নানা দিকে। যোগ্যতা, মেধা ও শ্রম দিয়ে নারীরা নানা অসাধ্য সাধন করছেন। তাঁরা ঘরে-বাইরে, দেশ পরিচালনায়, আকাশে, সাগরে, যুদ্ধের ময়দানে, চিকিৎসায়, সেবায় সব জায়গায় অবাধে সফলতার সঙ্গে বিচরণ করছেন।

বাংলাদেশে বেগম রোকেয়া ১৮৮০ সালে জন্ম নিয়ে সেই যুগে এ দেশে নারী শিক্ষার যে আলো জ্বালিয়ে গিয়েছিলেন, তারই পথ ধরে আজ এ দেশে মেয়েদের শিক্ষার হার প্রায় ৭৪ শতাংশ বেড়েছে। ইতিহাসে স্থান না পাওয়া এ রকম কাদম্বিনী, বেগম রোকেয়া বাংলাদেশের আনাচকানাচে অনেকে আছেন, যাঁরা নিভৃতে আলোর প্রদীপ জ্বালিয়ে গেছেন, আলোকিত করেছেন অনেক জীবন। আমি একজনের কথা জানি, তাঁর নাম জাহানারা ওয়াজেদ। যিনি মুক্তিযুদ্ধ বিধ্বস্ত পরবর্তী বাংলাদেশের অবহেলিত উপজেলা শেরপুরের মতো পিছিয়ে পড়া জনপদে নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী সংগ্রহ করে একটি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি ১৯৭২ সালে মাত্র ৫ জন ছাত্রী নিয়ে যাত্রা করা এই মহিলা মহাবিদ্যালয়টি পরে বিরাট মহিরুহে পরিণত হয়েছিল। এখন ওই অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি মেয়েই শিক্ষিত ও স্বনির্ভর।

আর এই ২০২০–এর করোনা মহামারিতে নারীরা আরেকবার তাঁদের মেধা, শ্রম ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন বিশ্ববাসীর কাছে নতুনভাবে। করোনা চিকিৎসায়, করোনা প্রতিরোধে, এ রোগের গবেষণায়, সর্বোপরি টিকা উদ্ভাবনে এবং করোনাকালে নিরাপদ দেশ পরিচালনাসহ ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় নারীরা বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, দিচ্ছেন। আমাদের দেশেই এর যথার্থতা মিলেছে এই করোনা মহামারিতে।

বিশ্বের প্রথম স্বেচ্ছাসেবী যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী জেনিফার হেলার
ছবি: সংগৃহীত

কোভিড ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে এখন বিশ্বজুড়ে। আমরা হারিয়েছি মা, বাবা, সন্তান, প্রিয়জন, স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশী, জ্ঞানী-গুণী, রথী-মহারথী অগণিত প্রাণ, যার ক্ষতি কখনো পূরণ হওয়ার নয়। আরও বেশি শঙ্কার কথা এই যে কত দিন এই ভাইরাসের তাণ্ডব চলবে বিশ্বে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। ইতিমধ্যে এই ভাইরাসের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও গঠনগত নানা পরিবর্তনের প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। করোনা প্রতিরোধে প্রথম থেকেই টিকা উদ্ভাবনে বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা নিরলস গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেকেই তাতে সফল হয়েছেন। বিশ্বের অনেক দেশে ইতিমধ্যে টিকা পৌঁছে গেছে। তলিকা অনুযায়ী নাগরিকদের টিকা দেওয়াও শুরু হয়ে গেছে।
এই কোভিড-১৯ ভাইরাস প্রতিরোধে টিকা আবিষ্কারের পেছনে প্রথম যে নামটি উঠে এসেছে, তা একজন নারীর। তিনি হলেন প্রফেসর সারা গিলবার্ট। ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণ করা গিলবার্ট অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। সারা গিলবার্ট টিকা বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত। তিনি ২০১০ সালে নতুন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং তিনি বাহকনির্ভর টিকা আবিষ্কারের অগ্রদূত।

ব্যক্তিগত জীবনে সারা গিলবার্ট একসঙ্গে (ট্রিপলেট) দুই কন্যা ও এক পুত্রসন্তানের মা হন। তখন অনেকেই ভেবেছিল সংসারের জাল হয়তো ‘গবেষক’ সারা গিলবার্টকে ম্লান করে দেবে ‘জননী’ সারা গিলবার্ট পরিচয়। কিন্তু এখানেও কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই কথাই সত্য হয়েছিল, ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’

কিছুদিন আগে সারা গিলবার্ট যুক্তরাজ্যের কোনো এক টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘তিনি ল্যাবরেটরি থেকে বাসায় গিয়ে যখন দেখেন, তাঁর স্বামী টেবিলে খাবার রেডি করে রেখেছেন, তখন তাঁর কাজের অনুপ্রেরণা বেড়ে যায় বহুগুণ।’ তাঁর তিন সন্তানই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে টিকা ট্রায়ালে গ্রহণ করার মাধ্যমে গবেষণায় অংশ নিয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে তাদের মায়ের সঙ্গে।

সারা গিলবার্ট যখন প্রথম বিধ্বংসী করোনা-১৯ ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার করেন ২৪ এপ্রিল ২০২০, তা মানবদেহে প্রয়োগ করা হয়। আর পরীক্ষাগারে প্রথম মানুষটি হলেন ৩২ বছর বয়সী এলিসা গ্রানাতো, একজন নারী যিনি এই ঝুঁকি নিয়েছিলেন। এলিসা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মলিকুলার বায়োলজিতে ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত আছেন। চ্যাডক্স০১ এনকোভি-১৯ টিকার মাধ্যমে এলিসার শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হলেই এগিয়ে চলে টিকা নিরীক্ষার বাকি কাজগুলো।

শুধু এলিসাই নয়, ৪৪ বছর বয়সী যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী জেনিফার হেলার বিশ্বের প্রথম স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে টিকা গ্রহণ করে ইতিহাসে স্থান করে নেন, যিনি একজন নারী। ইতিমধ্যে অনেক দেশের বিজ্ঞানীরা টিকা তৈরি ও গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, সফলও হয়েছেন। বিভিন্ন দেশে তার প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। এই টিকার মাধ্যমে করোনা মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় করে ইতিহাসের নতুন অধ্যায় রচিত হবে, সৃষ্টি হবে মানবসভ্যতার আরেক উজ্জ্বল মাইলফলক। করোনামুক্ত পৃথিবীর অপেক্ষায় আছে আজ মানবজাতি।

সহস্র স্যালুট মহীয়সী নারীদের, আর তাঁদের আত্মত্যাগকে। সেই আদিকালে প্রথম কৃষিকাজ ও ফসল উৎপাদন হয়েছিল এই নারীর হাত দিয়েই। আজও বিশ্ব এগিয়ে চলেছে এই নারীদের হাত ধরে। এই ভোগবাদী পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের জয়যাত্রা অব্যাহত থাকুক।

‘জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান,
মাতা ভগ্নি বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহান’।
অভিবাদন মহীয়সী নারীদের।

  • লেখক: ডা. মালিহা পারভীন, ঢাকা