এক বর্ষার রাতে

ছবি: সোয়েল রানা

গভীর রাত। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে টুপটুপ করে। খোলা জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে। তনিমার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো বাতাসে উড়ছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিদ্যুতের আলোয় ক্যালেন্ডারে চোখ পড়ল তনিমার। গত মাসের পাতা এখনো ওল্টানো হয়নি৷ এখন কী মাস চলছে? সে মনে করতে পারছে না। হয়তো আষাঢ়–শ্রাবণ মাস। এই দুই মাসে সারা দিন কখনো মুষলধারে, কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি আকাশজল মানুষকে ভোগাবে, আনন্দ দেবে—এটাই স্বাভাবিক। কবি ও লেখকদের কাছে বোধ হয় সবচেয়ে আনন্দেরও মাস দুটি।

এই দুই মাসে পুকুর, খাল, বিলে উপচে পড়া জল আর শহরের রাস্তায় হাঁটুজল দেখতেই অভ্যস্ত সবাই।

সেদিন তনিমা বাসা থেকে বের হচ্ছিল। রাস্তার পাশেই ময়লার স্তূপ। স্তূপের পাশেই ময়লার নালা। পুরো শহরের মানুষের আবর্জনা। নালায় ঢাকনা নেই। গত বছর থেকে কাজ চলছে। এখনো চলছেই। কবে যে শেষ হবে কে জানে!

একটা ছোট ছেলে তার মায়ের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। এলোমেলোভাবে হাঁটছে। তার মা ধমক দিয়ে বলল, ‘এই নাফিস, নালায় পড়ে যাবি কিন্তু। দেখেশুনে হাঁটতে পারিস না?’ বলতে বলতে ছেলেটার মা-ই ময়লার নালায় পড়ে গেল। দেখে ছেলেটা হেসে কুটিকুটি।

দুই দিন ধরে তনিমার মাথায় ছবিটা গেঁথে আছে। ছবিটা আঁকতে পারলে হয়তো মাথাব্যথাটা দূর হতো। কিন্তু ছবি আঁকতে তার ভালো লাগে না। শৈশবে সে খুব ছবি আঁকত। বাসার দেয়ালে আঁকাআঁকির কারণে তনিমার বাবা খুব মেরেছিল। সেদিন থেকে তার ছবি আঁকাও বন্ধ হয়ে গেছে।

আজ আবারও আঁকতে ইচ্ছা করছে। পুরো ঘরের দেয়ালজুড়ে মা–ছেলের ছবিটা আঁকলে হয়তো মন্দ হবে না। আচ্ছা, এখনো কি বাবা আমায় মারবে? নাহ, বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আচমকা কোনো একদিন এসে বলবে, ‘তনিমা, মা রে, কুসুম কুসুম গরম পানি দে। গোসল করে আসি। বুঝলি, মেলা দিন গোসল করি না। হা হা! আর পারলে এক কাপ চা দিস। তোর হাতের চা খাওয়ার জন্যই আমি বারবার আসি।’

বাবা অনেক দিন হলো আসছে না। বাবাকেও আজ দেখতে ইচ্ছা করছে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, বৃষ্টির মতো বাবাও যেন আসে ক্ষণিকের অতিথি হয়ে।

বর্ষার ঝরঝর মিষ্টি সেই রূপ আর নেই। আষাঢ়-শ্রাবণে আর অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয় না। বদলে গেছে চিরায়ত রূপ। শুধু তা–ই নয়, বৃষ্টির রূপবদলের সঙ্গে বাড়ছে অনাবৃষ্টি।
তনিমা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছা করছে না তার। পুরো বাড়ি ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই।

তনিমার মা নানুবাড়ি গিয়েছে। ঠিক সন্ধ্যাবেলায়। নানু খুব অসুস্থ। আজ হয়তো আসতে পারবে না। তনির চোখে ঘুম নেই। মাথা ধরেছে।

এক কাপ চা হলে ভালো হতো।

কাজের বুয়াটাও চলে গেছে দুদিন আগে। যাওয়ার সময় তনিমার দুটো শাড়ি চুরি করে নিয়ে গেছে। সে আবার আসবে কি না, বলা যাচ্ছে না।

আসতেও পারে। এদের ঠিকঠিকানা নেই। নতুন কোথাও গিয়ে মাস দুয়েক কাজ করে ওখান থেকেও পালাতে পারে। ঢাকা শহরে এখন নতুন বুয়া পাওয়া খুব মুশকিল। এদের এখন চাহিদা বেশি।

বিদ্যুৎও চলে গেল। ঘর অন্ধকার। পাশের ঘর থেকে বইয়ের পাতা ওল্টানোর শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ খুব মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। একটু পরপর জিহ্বা থেকে থুতু নিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছে। মাঝেমধ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।

ভয়ে তনিমার শরীর কাঁপছে। বুক ধড়ফড় করছে তৃষ্ণায়। বিছানা থেকে উঠে সে মোমবাতি জ্বালাল। বাতাসে মোমবাতি নিভু নিভু করছে। পাশের ঘরটায় উঁকি দিয়ে দেখে এল। না, কোথাও কেউ নেই।

বাতাসে জানালার কপাট নড়ে উঠতেই সে ভয়ংকর চমকে উঠল। হাত থেকে মোমবাতি মেঝেতে পড়ে গেল। বড্ড ভয় হচ্ছে তার। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। দৌড়ে পালাতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু বাইরে প্রচুর বৃষ্টি।
ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তার আলোয় চারদিক ঝলমল করে উঠছে। আবার সব ঢেকে যাচ্ছে অন্ধকারে।
তনিমা চোখ খুলে দেখে, সে বিছানায় শুয়ে আছে। মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর পানি ঢালছে। গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। মুখ তেতো হয়ে গেছে। মাথা ভার ভার লাগছে।
এপাশ-ওপাশ করার মতো শক্তিও তার নেই।
চুলগুলো শুকনা কাপড় দিয়ে মুছতে মুছতে তনিমার মা বলল,‘এখন কেমন লাগছে তোর?’
—খুব ভালো, মা।
—গত রাতে খুব ভয় পেয়েছিলি বুঝি?
—হ্যাঁ, এখনো পাচ্ছি। খুব ভয় করছে আমার। আমাকে একটু জড়িয়ে ধরে রাখো না মা।