আমার বাবা: শিক্ষার স্বপ্নচারী

ছবি: সংগৃহীত

গোপালগঞ্জ ও নড়াইল জেলা দুটিকে আলাদা করেছে মধুমতী নদী। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ইতনা ইউনিয়নের পাংখারচর গ্রামটি মধুমতী নদীর গাঁ ঘেষে। এ গ্রামেরই কিছুটা ডানপিঠে স্বভাবের যুবক রাজা। বাবাহীন সংসারের হাল ধরার জন্য নিজের পড়ালেখার ইচ্ছাটাকে জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। দীর্ঘদিন পুলিশ বাহিনীকে সেবা দিয়ে যখন পুলিশ বাহিনী থেকে অবসরে যান, তখন তিনি আর সেই ডানপিঠে রাজা নন। তখন তিনি অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা (পুলিশ পরিদর্শক) আব্দুর রজ্জাক মল্লিক। তিনি আমার বাবা। নয় সন্তানের জনক। তিন মেয়ে আর ছয় ছেলের কর্তব্যপরায়ণ এক পিতা। জীবনসংগ্রামে নিজের উচ্চশিক্ষার ইচ্ছাটা জলাঞ্জলি দিলেও উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। নিজের পূরণ না করা সেই স্বপ্নকে তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন নিজের সন্তান আর পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে।

বাবা যখন চাকরি থেকে অবসরে যান তত দিনে বড় আপা এবং মেঝ আপা স্নাতক পাস করেছেন। বড় ভাই ও ছোট আপা সবে কলেজের গণ্ডিতে পা রেখেছেন। চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলার শহর এলাকায় থাকলেও অবসরের পর বাবা পুরো পরিবার নিয়ে পাংখারচর গ্রামে বসবাস করতে শুরু করেন। গ্রামে সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও সন্তানদের লেখাপড়া করানোর স্বপ্ন বা আশা তিনি কোনোভাবেই ছেড়ে দেননি। শুরু হলো আমার বাবা ও মায়ের নতুন সংগ্রাম। শত দুঃখ-কষ্টের মাঝেও তাঁরা দুজনে আমাদের লেখাপড়ায় আশা দিয়েছেন এবং উৎসাহ জুগিয়েছেন। তত দিনে আমার বড় ভাই ইন্টারমিডিয়েট পাস করে মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে শুরু করেন। ছোট আপা উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। আমার বাকি ভাইয়েরা তখনো কেউ স্কুলের গণ্ডি পার হয়নি।

বাবা দিবস সংখ্যার জন্য অলংকরণ

সামান্য পেনশনের টাকা এবং কৃষি থেকে আয় দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালানো কঠিন হলেও বাবা সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিতেন তাঁর সন্তানেরা শিক্ষিত হবে এ আশায় বিভোর হয়ে। এ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমার বড় ভাই ডাক্তার হয়েছেন, দ্বিতীয় ভাই পরিসংখ্যানে সম্মানসহ বিএসসি ও এমএসসি করেছেন, তৃতীয় ভাই অর্থনীতিতে সম্মানসহ বিএ ও এমএ পাস করেছেন আর চতুর্থ ভাই এমবিবিএস পাস করেছেন। বাবা যখন মৃত্যুবরণ করেন, তখন আমার পঞ্চম ভাই এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের ছাত্র এবং আমি মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছি। পরে আমার পঞ্চম ভাই এমবিবিএস পাস করেন এবং আমি কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়া থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করি।

বাবার পুরো পরিবারের সদস্যদের শিক্ষার সার্বিক চিত্র এক জায়গায় করলে দাঁড়ায়- প্রথম সন্তান (মরহুমা) ফিরোজা বেগম খুকু (স্নাতক) এবং দ্বিতীয় সন্তান জাহানারা বেগম বেবী (স্নাতক) সরকারি চাকরি থেকে অবসরে আছেন। তৃতীয় সন্তান ডা. বশিরুল আলম মল্লিক (সরকারি চাকরি থেকে অবসরে আছেন) ও তাঁর স্ত্রী (মরহুমা) জহরত আরা নীরু মনোবিজ্ঞানে সম্মানসহ বিএ ও এমএ এবং তাঁদের বড় মেয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানে সম্মানসহ বিএসসি ও এমএসসি ও ছোট মেয়ে চিকিৎসক। চতুর্থ সন্তান মনোয়ারা বেগম মনু (আইএ, পিটিআই), সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে অবসরে আর পঞ্চম সন্তান মো. জাহাঙ্গীর আলম মল্লিক পরিসংখ্যানে সম্মানসহ বিএসসি ও এমএসসি (কলেজশিক্ষক হিসেবে অবসরে)। ষষ্ঠ সন্তান একটি গ্রুপ অব কোম্পানিতে সহকারী জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত মো. আলমগীর কবীর মল্লিক অর্থনীতিতে সম্মানসহ বিএ ও এমএ, তাঁর স্ত্রী আইভিন চৌধুরী অর্থনীতিতে সম্মানসহ বিএ ও এমএ এবং তাঁদের বড় মেয়ে সদ্য পাস করা ডেন্টাল চিকিৎসক ও ছোট মেয়ে এ বছর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়তে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হয়েছেন।

সপ্তম সন্তান ডক্টর অব মেডিসিন (এমডি) ও এমসিপিএস ডিগ্রিধারী বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. খসরুল আলম ও তাঁর স্ত্রী রেডিওলজি বিশেষজ্ঞ ডা. সাদিকা পারভীন খুলনা মেডিকেল কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত এবং তাঁদের মেয়ে মাত্র কয়েক দিন আগে এমবিবিএস পাস করে ডাক্তার হয়েছেন। অষ্টম সন্তান ডক্টর অব মেডিসিন (এমডি) ডিগ্রিধারী গ্যাস্ট্রোএন্টারোলোজি বিশেষজ্ঞ ডা. শাহীদুল হাসান খুলনা মেডিকেল কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে এবং তাঁর স্ত্রী প্যাথলজি বিশেষজ্ঞ ডা. শাহনাজ পারভীন খুলনা মেডিকেল কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। নবম সন্তান (লেখক নিজে) অধ্যাপক ড. আবু শামীম মোহাম্মদ আরিফ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের শিক্ষক হিসেবে এবং তাঁর স্ত্রী আইনে সম্মানসহ এলএলবি ও এলএলএম ডিগ্রিধারী রোজিনা আক্তার একজন জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে কর্মরত আছেন।

অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপনকারী আমার বাবা আব্দুর রজ্জাক মল্লিক ছিলেন নিরহংকার, অমায়িক, সদালাপি, পরোপকারী ও ধার্মিক। নিজ পরিবারে সন্তানদের নিয়ে শিক্ষার যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, সেটি ধীরে ধীরে আরও বিকশিত হয়েছে। আমার বাবার হয়তো আরও বড় স্বপ্ন ছিল, যেগুলো পূরণ হয়নি। কিন্তু সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে নিজের সন্তানদের সবাইকে শিক্ষিত করে তোলার যে স্বপ্ন তিনি বুনেছিলেন এবং একটা উচ্চশিক্ষিত পরিবারের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, সেটি নিশ্চয়ই কিছুটা হলেও পূরণ হয়েছে। এমন ভাগ্যই বা কয়জনের হয়। নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার পাংখারচর গ্রামের শিক্ষার স্বপ্নচারী আমার বাবা এবং তাঁর স্বপ্ন পূরণকারী পরিবারের সবার প্রতি অনেক শ্রদ্ধা। আমার বাবা আমাদের জন্য কোনো সম্পদ রেখে যেতে পারেননি, কিন্তু তিনি আমাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার পথ দেখিয়েছেন। আমরা আমাদের বাবার জন্য গর্বিত। বাবা দিবসে বাবার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

*লেখক: ড. আবু শামীম মোহাম্মদ আরিফ, অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়