আফজাল সাহেবের শুক্রবার

ছবি: হাসান মাহমুদ

আফজাল হোসেইন। চাকরি করেন ব্যস্ত রাজধানীর ছোটখাটো একটি প্রাইভেট ফার্মে। সারা দিন অফিসে অসম্ভব রকমের পরিশ্রম করেন। সপ্তাহে ছয় দিন অফিস। শুক্রবার ছুটি। অফিসের উদ্দেশে বের হন সেই সকাল সাতটায়। রাতে বাসায় ফেরেন কখনো আটটায় বা কখনো নয়টায়। অফিস টাইম শেষে বাড়তি কাজ না করলে বস আবার খুব একটা পছন্দ করেন না। তার অফিস সহকর্মীদের ভাষ্যমতে তিনি একজন বাস্তবের আয়রনম্যান। মেটাল বডি না হলে এত কাজ করা কীভাবে সম্ভব!

অন্যান্য দিন অফিস শেষ করে একটু আগে বাসায় ফিরতে পারলেও বৃহস্পতিবার কোনোভাবেই আগে যাওয়ার সুযোগ হয় না তার। কারণ, তার বস এই দিনটাতে নিজেও ওভারটাইম করেন। বস বের হন নয়টার দিকে, এরপর বের হন তিনি। বরাবরের মতো আজ বৃহস্পতিবার। আজও বাসায় ফিরতে ফিরতে নিশ্চিত রাত ১০টা–১১টা বাজবে তার।

এই বৃহস্পতিবারটাতে রাস্তায় কেন যে এত যানজট থাকে, তার কোনো মানেই খুঁজে পান না আফজাল সাহেব। কোথায় আজকে একটু আগে বাসায় ফিরবেন, পরিবারকে সময় দেবেন, সেখানে এই লোকাল গাড়িতে ঘর্মাক্ত হয়ে বসে থাকতে হবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নাহ্‌ আর ভালো লাগে না এত প্যারা। অফিসের প্যারা, বসের প্যারা, যানজটের প্যারা, আর বাসার প্যারা তো আছেই! এত কিছু ভাবতে ভাবতেই আফজাল সাহেবের ফোনে নায়লার কল।
—কই তুমি?
—এই তো গো, লম্বা জ্যামে আটকে আছি!
—কেন, বসকে বলে আজকে একটু আগে বের হওয়া যেত না?
—তুমি তো সবই জানো। বসের মেজাজ যে সব সময় চড়া থাকে! তার ওপর উনি এই দিনটায় নিজেও অফিসে থাকেন অনেকটা সময়, কীভাবে বলি?
—এত শত বুঝি না, তুমি আমাদের এইভাবে সময় না দিতে পারলে বাপের বাড়িতে দিয়ে আসো। এইভাবে আমার পক্ষে একা সব সামলানো কঠিন!
—রাগ করোনা গো! আমি আসছি। সাজিদ, সারিনা ঘুমাইসে?
—আব্বু-আব্বু করতে করতে ঘুমাইয়েই পড়ল একটু আগে।
—ওকে, আমি কাছাকাছি চলে আসছি। রাখলাম।
রাখলাম বলার পর আরও প্রায় মিনিট ৪০ পর আফজাল সাহেব বাসায় পৌঁছালেন। বাসায় কখনো রাতে কলিং বেল চাপেন না তিনি। বাচ্চাদের আবার ঘুম ভেঙে যায় কি না! এক ছেলে, এক মেয়ের সংসার আফজাল সাহেবের। ছেলে পড়ে ক্লাস ফাইভে, মেয়ে ক্লাস টুতে। বাসার সবকিছু তার স্ত্রী নায়লাই সামলান। তাই নায়লার মেজাজও থাকে সব সময় চড়া।

রাত ১২টা

গোসল সেরে রাতের খাবার খেতে বসেছেন আফজাল সাহেব। ছেলেমেয়েদের নিয়ে আগেই ঘুমিয়ে পড়েছেন নায়লা। টেবিলে ভাত–তরকারি সব রাখাই ছিল। কিন্তু আফজাল সাহেব খেতে গিয়ে দেখেন সব ঠান্ডা হয়ে আছে। অগত্যা চুলা জ্বালিয়ে নিজেই সবকিছু গরম করে তারপর খেতে বসলেন! খেয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে রাত তখন প্রায় পৌনে একটা বেজে গেল। ঘুমানোর আগে ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীর মুখখানা দেখে মনটা খারাপই হয়ে গেল তার। আহা রে, কাউকে একটুকুও সময় দিতে পারেন না। নিজের ওপর বড্ড অভিমান হলো তার! নাহ, এখন থেকে অফিসে ওভারটাইম কমিয়ে দিতে হবে। বসের ওপর একদিন নিজেও চড়াও হবেন তিনি। এভাবে দিনের পর দিন চলতে দেওয়া যায় না। হয় এসপার নয় ওসপার৷ এগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলেন আফজাল সাহেব, তা টেরও পেলেন না।

ফাইল ছবি

রাত ৩টা

আফজাল সাহেব তো বাড়িতে ফিরেছেন। কিন্তু আবার তিনি লোকাল গাড়িতে কেন? ইশ্‌, ঘেমে কি অবস্থাটাই না হয়েছে তার! হঠাৎ একটা স্টপেজ থেকে যাত্রী হিসেবে নায়লাকে গাড়িতে উঠতে দেখলেন। নায়লা বলা নাই কওয়া নাই এত মানুষের ভিড়ে বিশাল একটা হাতপাখা নিয়ে বলতে শুরু করলেন ‘কই, বাতাস করো..!’
ততক্ষণে আফজাল সাহবের ঘুম ভাঙল। ঘেমে একাকার। এতক্ষণ ধরে স্বপ্নের মধ্যে ছিলেন বুঝতে পারলেন। বাস্তব যেটা তা হলো অনেকক্ষণ হলো ইলেকট্রিসিটি নেই বাসায়। আর তার স্ত্রী নায়লা তাকে ডাকছেন তাকেসহ ছেলেমেয়েকে বাতাস করার জন্য।
—কত দিন বলেছি, একটা চার্জার ফ্যান কিনো, চার্জার ফ্যান কিনো, তা কিনবে কেন? এখন নাও, বসে বসে বাতাস করো আমাদের!
—আহা, আস্তে। বাচ্চাদের ঘুম ভাঙবে তো!
—ভাঙুক।
—আচ্ছা দাও, আমি বাতাস করছি।
এই বলে প্রায় ফজর নামাজের ওয়াক্ত পর্যন্ত ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে স্ত্রী আর বাচ্চাদের বাতাস করেই গেলেন বেচারা আফজাল সাহেব। এরপর আর পেরে উঠলেন না। কখন ঘুমিয়ে পড়লেন টের পেলেন না।

শুক্রবার সকাল ৮টা:
প্রচণ্ড চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আফজাল সাহেবের।
—কইগো, ঘুম ভাঙল তোমার?
—আহা, একটু ঘুমাতেও দিবে না নাকি?
—ঘুমাতে দিই কিভাবে? সারা সপ্তাহে এই একটা দিন থাকো বাসায়, বাজারসদাই এগুলা তো করা লাগবে নাকি? খেয়ে বাঁচতে হবে না?
—আচ্ছা বাবা, যাচ্ছি।

ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে আফজাল সাহেব উঠলেন শেষ পর্যন্ত। ফ্রেশ হয়ে নাশতা না করেই বাজারের ব্যাগ নিয়ে বের হলেন। এ বাজার মানে আরেক প্যারা। দরদাম করো, বিক্রেতাকে কনভিন্স করো, ঠকলাম না জিতলাম, বাজারের ভিড়—ভালো লাগে না একদম। কখনো যদি অনেকে টাকা হয় তার, তাহলে বিক্রেতা যা বলবে সেই দামেই সবকিছু কিনবেন তিনি। এভাবে তর্কাতর্কি করে বাজার করা খুব কঠিন।

ফাইল ছবি

বেলা ১১টা

দুই ভারী ব্যাগভর্তি বাজার করে এগুলো পাঁচতলায় কষ্ট করে ওঠালেন। কারণ, তার বাসা পাঁচতলাতেই কিনা! ছাদের নিচে বাসা হওয়ায় একটু কম ভাড়াতেই বাসা পেয়েছিলেন, এ নিয়ে তো নায়লার প্রতিদিন ই ঝগড়া চলে। যাক সে প্রসঙ্গ আপাতত বাদ। বাজার উঠিয়ে, ফ্রেশ হয়ে নাশতা খেতে বসলেন। ততক্ষণে বাচ্চাদের টিচার চলে এসেছে বাসায়। বাচ্চারা টিচারের কাছে পড়তে বসেছে। টিচার যেতে যেতে একদম ১২টার পর। নাশতার পরের একটা ঘণ্টা টিচারের নাশতা রেডি করে, নায়লাকে দুপুরের রান্নায় সহযোগিতা করেই কেটে যায় তার।

দুপুর ১২টা ৩০

নিজের গোসল সারতে হবে। বাচ্চাদের গোসল করাতে হবে। সাজিদকে রেডি করতে হবে, নিজেকেও রেডি হতে হবে জুমার নামাজের জন্য। প্রতি শুক্রবারেই ভাবেন একটু আগে আগে গিয়ে মহল্লার মসজিদের নিচ কিংবা দোতলায় এসির নিচে বসে হুজুরের বয়ান শুনবেন। কিন্তু সবকিছু সেরে উঠতে উঠতে তা আর হয়ে ওঠে না। মসজিদে যেতে যেতে জায়গা মিলে হয় ছাদে কিংবা রাস্তায় দাঁড়ানো মুসল্লিদের সারিতে।

বেলা ৩টা ৩০

নামাজ ও খাওয়া শেষ করে বাচ্চাদের কাছে নিয়ে একটু আয়েশ করে বিছানায় কেবল গা–টা এলিয়ে দিয়েছেন আফজাল সাহেব, ঠিক তখনি নায়লা মাথার চুলগুলো বেণি করতে করতে এসে বললেন—
—কইগো সাজিদের আব্বু, ঘুমাইলা নাকি?
—না।
—চলো না, বিকেলে বাচ্চাদের নিয়ে একটু কোথাও বেরিয়ে আসি?
—কীভাবে যাই বলো তো? সপ্তাহে ছয় দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম যায়। এই এক দিন পাই ফ্রি। তাও সকাল থেকে এটা–ওটা করতে করতে কতটা সময় চলে গেল! এখন আসছি বেডে, তা–ও যদি একটু ঘুমাতে না পারি!
—আসলে তোমাকে বলাটাই আমার ভুল হয়েছে। আমরাও তো বাসায় ছয় দিন একা একা থাকি! কোথাও যেতে পারি না, ঘুরতে পারি না, বাচ্চাদের জন্য হলেও তো বের হওয়া উচিত নাকি?
বলেই আধো আধো কান্না শুরু করে দিলেন নায়লা। আফজাল সাহেব বুঝলেন আজকে খবরই আছে তার! তাই অনেক কষ্টে নায়লাকে শান্ত করে বিকেল পাঁচটার দিকে বাসার পাশেই নায়লা আর বাচ্চাদের একটা পার্কে নিয়ে গেলেন তিনি। পার্ক তো নয়, পুরো ধুলাবালির আড্ডাখানা, আর তার সঙ্গে শত শত মানুষের ভিড়! আফজাল সাহেব ঘণ্টাখানেক সময় কাটিয়ে দ্রুত পরিবার নিয়ে প্রস্থান করে বাসায় চলে এলেন। বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বেজে গেল।

রাত আটটা

আফজাল সাহেব কেবল ফ্রেশ হয়ে টিভির রিমোটটা হাতে নিয়েছেন। তখনি সাজিদ, সারিনা তাদের হোমওয়ার্ক খাতা নিয়ে হাজির! টিভিটা অন করার আগেই আফজাল সাহেব সাজিদের ম্যাথ আর সারিনার ইংলিশ হোমওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ততক্ষণে নায়লা রিমোটটা নিজের কাছে নিয়ে স্টার জলসায় রাত আটটার সিরিয়াল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
রাত পৌনে নয়টা
—কইগো সাজিদের আব্বু, বাসার পাশে একটা চায়নিজ রেস্তোরাঁ হয়েছে, দেখসো?
—হুম, দেখসি। কী যেন নাম?
—হু চুয়াং চায়নিজ রেস্তোরাঁ।
—হুম।
—চলো না আজকে ওখানে ডিনার করি! তুমি তো আমাদের বাইরে খাওয়াতেই নিয়ে যাও না!
আফজাল সাহেব বুঝলেন যে কয়েক হাজার টাকার খরচা প্লাস পেট খারাপের ঝুঁকি! তাই ভিন্ন কৌশল নিলেন।
—আচ্ছা নায়লা, তার চেয়ে এক কাজ করলে কেমন হয়?
—কী?
—সকালে তো পোলাওয়ের চালও আনলাম, মুরগিও আনলাম বাজার থেকে। তা দিয়ে আমি আর তুমি মিলে বিরিয়ানি রান্না করলে কেমন হয়? তা ছাড়া সাজিদ, সারিনারও খুব পছন্দ বিরিয়ানি।

—আইডিয়াটা মন্দ না। ভালোই হয়। কিন্তু আমি কিছু করতে পারব না। নয়টায় একটা সিরিয়াল আর সাড়ে নয়টায় স্টার প্লাসে একটা শো আছে। তুমি রান্না করে খাওয়ালে ঠিক আছে, আর নয়তো হু চুয়াংয়ের চায়নিজ খাওয়াও। দেখো কোনটা করবে?
আফজাল সাহেব চিন্তা করলেন, বাইরে গিয়ে চায়নিজ খেয়ে হাজার টাকা খরচ করার চেয়ে নিজে একটু কষ্ট করে বিরিয়ানিটা রান্না করে নিলে মন্দ হয় না! অনেকগুলো টাকাও বেঁচে যায়। তাই মোটামুটি একাই প্রায় ঘণ্টাখানেক পরিশ্রম করে বিরিয়ানি রান্না করে ঘেমে একাকার হয়ে রান্নাঘরের সংগ্রামে জয়ী হলেন।

রাত ১২টা

বিরিয়ানি খেয়েদেয়ে নায়লা, সাজিদ, সারিনা ঘুমিয়ে পড়েছে একটু আগেই। আফজাল সাহেবও শুয়ে পড়েছেন। কিন্তু ঘুম আসছে না। আবার কাল থেকে একটানা ছয় দিন অফিস। আবার সেই হাড়ভাঙা পরিশ্রম। একটা দিন সময় পেলেন, তা–ও কীভাবে যে চলে গেল টেরই পেলেন না! বিশ্রাম নেওয়ারও সুযোগটা মিলল না। সারা দিন এটা–ওটা করেই সময় চলে গেল। ঘুমানোর আগে সাজিদ, সারিনা আর নায়লার মুখটাকে একবার দেখে নিলেন তিনি। গত রাতের চেহারার সঙ্গে আজকের রাতের নায়লার চেহারার বড্ড অমিল! গত রাতের চেহারাটা ছিল বিরক্তির, আর আজকেরটা ভালোবাসা ও আত্মতৃপ্তির, যা কিনা আফজাল সাহেবের অফিসের প্রতিদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি কিংবা আজকের সারা দিনের পরিশ্রমের থেকে অনেক অনেক দামি। এ এতটুকুই তার আগামী ছয় দিনের ব্যস্ততা আর হাড়ভাঙা পরিশ্রমের অবলম্বন।