অরিন্দ্রমের চিঠি

প্রতীকী ছবি

খুব সকালে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল পুষ্পিতার। তখন পাখিরাও হয়তো ঘর থেকে বের হয়নি। পুষ্পিতার আর ঘুমাতে ইচ্ছা হয়নি। সোজা চলে গিয়েছিল কিচেনে। গরম চা নিয়ে চলে যায় বারান্দায়। এখনো শীত পড়েনি ওভাবে, তবে সকালবেলা হালকা কুয়াশা থাকে। পাখিরা ঘর থেকে না বের হলেও অনেকেই জীবিকার সন্ধানে বের হয়ে গেছে। পুষ্পিতা কাঁধে হাতের স্পর্শ অনুভব করল।

‘এত সকালে ঘুম ভেঙে গেল?’

মায়ের চোখে উদ্বিগ্নতা। পুষ্পিতাকে নিয়ে আসলে বাসার সবাই চিন্তিত। বাসার সবার ধারণা, সে ভয়ংকর কোনো মানসিক রোগে ভুগছে। যদিও পুষ্পিতা সেটা মনে করে না। আসলে কেউ নিজেকে অসুস্থ ভাবতে পছন্দ করে না। ভালোই ছিল পুষ্পিতা, বছর পাঁচেক আগে শুরু হলো এই যন্ত্রণা।

পাঁচ বছর আগে ঠিক এমনই এক দিনে, বাসার সবাই বাইরে। দুদিন পর পুষ্পিতার বিয়ে, সবাই গেছে শপিংয়ে। পুষ্পিতা যায়নি, আসলে তাকে নেওয়া হয়নি। মায়ের কথা, রোদে ঘুরলে কালো লাগবে অনুষ্ঠানের দিন। পুষ্পিতা বারান্দায় তার গাছগুলো দেখছিল। ঠিক তখন বুয়া এসে তাকে একটা খাম দিল। ওপরে পুষ্পিতার নাম লেখা আর কিছু না। গৃহকর্মী বলল, দরজার নিচ দিয়ে দিয়ে গেছে। পুষ্পিতা অবাক হলো এটা ভেবে, পাড়ার ছেলেরা তার কলেজপড়ুয়া ছোট বোন অর্পিতাকে এমন চিঠি দিতেই পারে, কিন্তু চিঠিটা তার নামে হলো কীভাবে? সাদা খামের কোনাটা ছিঁড়ে পুষ্পিতা চিঠিটা বের করল। মাত্র দুটো লাইন লেখা

‘পুষ্পিতা

তোমার ছোট খালু তো মারা গেছেন, তার মেয়ে দুটোর কী হবে বলো তো?

ইতি
অরিন্দ্রম’

পুষ্পিতার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। এসব কী লেখা আর অরিন্দ্রমই–বা কে? ঘোর কাটল কলবেলের শব্দে। একটানা বেজেই চলছে। বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতেই দেখল মা–অর্পিতা ফিরে এসেছে। অর্পিতা মাকে ধরে নিয়ে আসছে। পুষ্পিতাকে দেখেই অর্পিতা বলল, ‘আপু ছোট, খালু মারা গেছেন একটু আগে। খবর শুনেই মা অসুস্থ হয়ে গেছে, তুই একটা উবার ডাক তো। আমাদের খালার বাসায় যেতে হবে।’

পুষ্পিতা এক দৌড় দিয়ে ঘরে এল, চিঠিটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে পেল না।

এরপর যা হওয়ার তা–ই হলো। এমন একটা অদ্ভুত ঘটনা আর চাপা থাকল না। আরও অদ্ভুতভাবে পুষ্পিতার বিয়েটা ভেঙে দিল ছেলেপক্ষ কোনো কিছু না বলেই এবং ছয় মাস–এক বছর গ্যাপ দিয়ে দিয়ে পুষ্পিতা এমন চিঠি পেতে লাগল।

প্রথম চিঠিটা পাওয়ার ছয় মাস পর পুষ্পিতা পরবর্তী চিঠিটি পেল। এর মধ্যে সে অনেক খোঁজ নিয়েছে, অরিন্দ্রম কে? তার কোনো স্কুল বা কলেজের বন্ধু, নাকি পাড়ার কেউ! যদি পাড়ার কেউ হয়ে থাকে, তবে চিঠির কথা কীভাবে সত্য হচ্ছে? কোনো উত্তর পুষ্পিতা পায়নি।

এরপর একদিন এল দ্বিতীয় চিঠি। পুষ্পিতা বিকেলে একটু ঘুমিয়ে ছিল, যাকে বলে ভাতঘুম। ঘুম থেকে জেগে লাইট জ্বালাতেই টেবিলের ওপর দেখতে পেল চিঠিটা। একই রকম খামে চিঠিটা।

‘পুষ্পিতা

আমি কে সেটাই তো ভাবছ? আমি অরিন্দ্রম। এখন বলো না অরিন্দ্রম কে? আসলে তুমি আমাকে চেনো না। কোনো দিন দেখোনি, কথাও শোনোনি। চিনে কী হবে বলো? আমরা কি সবাই সবাইকে খুব ভালো চিনি। এই যেমন ধরো তোমার বোন অর্পিতা কি জানে তুমি ইচ্ছা করে তার গোলাপগাছটা তুলে ফেলেছ? বা তুমি কি জানো অর্পিতা প্রায় তোমাকে না জানিয়ে তোমার ফোনটা দেখে? বিশেষ করে তোমার বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পর থেকে। কারণ, তাদের ধারণা তুমি ইচ্ছা করে বিয়েটা ভেঙেছ। তোমার কোনো সম্পর্ক আছে। এক ছাদের নিচে থেকেও তোমরা কেউ কাউকে চেনো না, তাহলে আমাকে চিনে কী করবে? এই যা! এত কথা বলছি, আসল কথাটা বলিনি, কাল বাসায় থেকো, সামনের বাসার মল্লিক সাহেবকে নিয়ে হাসপাতাল যেতে হবে, যদিও লাভ হবে না...
ইতি
অরিন্দ্রম।’

২.

মল্লিক সাহেবের মৃত্যু পর পুষ্পিতাকে ডাক্তার ফারজানার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। ফারজানা চিঠিগুলো দেখতে চাইলেও পুষ্পিতা দেখাতে পারল না। আসলে দেখাবে কীভাবে? চিঠি পড়ার পর তো আর খুঁজেই পায় না সে। আর দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিও চিঠি দেখতে পায় না।

ফারজানার কথামতো এসব পুষ্পিতার কল্পনা। তার বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পর সে খুব ডিপ্রেশন চলে গেছে। সেদিন কোনো চিঠিই সে পায়নি, কারণ না সে চিঠিটা দেখাতে পেরেছে, এমনকি গৃহকর্মীও বলেছে, সে পুষ্পিতাকে কোনো চিঠি দেয়নি। তার মানে পুরোটাই পুষ্পিতার কল্পনা। তা ছাড়া পুষ্পিতা খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে। খুব সহজে কাউকে কিছু খুলে বলে না। বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় সে এতটাই কষ্ট পেয়েছে, সেই থেকেই তার এই ডিপ্রেশন। সময় লাগবে, কিন্তু পুষ্পিতা আবার আগের জীবনে ফিরে যাবে। অরিন্দ্রম একটা কল্পনামাত্র।

গত একটা বছর কোনো চিঠি আসেনি। পুষ্পিতা একটু একটু করে আগের আগের জীবনে ফিরে আসছে। বেশ কিছু দিন ছোট খালার বাসায় থেকে এসেছে, খালু মারা যাওয়ার পর তার ভাইয়েরা তাদের সম্পত্তি নিয়ে অনেক ঝামেলা করছে, মেয়ে দুইটা নিয়ে খালা অনেক কষ্টে আছে। অরিন্দ্রম পুষ্পিতাকে প্রশ্ন করেছিল, তার মেয়ে দুইটার কী হবে? উত্তরটা অরিন্দ্রম বলে দিলে ভালো হতো, কারণ অরিন্দ্রম তো ভবিষ্যৎ বলতে পারে!

মাগরিবের আজানে ঘুম ভাঙল পুষ্পিতার। পুষ্পিতার অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। অনেক দিন অরিন্দ্রমের কোনো চিঠি আসে না। চিঠি কথা মনে হতেই ওর মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেল। মেডিসিনের বক্সটা খুলতেই চিঠিটা পেল।

‘পুষ্পিতা
কেমন আছ? অনেক দিন পর আজ আবার লিখছি। আসলে সময় না হলে তো আমি লিখতে পারি না। আমি তোমাকে চিঠি না লিখলেও আমি কিন্তু জানি তুমি কোথায়, কেমন আছ। তুমি ভাবছিলে ছোট খালার মেয়ে দুইটার কী হবে, সেটা কেন আমি বললাম না...আরে পাগল, আমি কি ভবিষ্যৎ বলতে পারি? তাহলে তো বলেই দিতাম তোমার নাইট কুইনগাছে কবে ফুল ফুটবে, যেটার অপেক্ষায় তুমি আছ। ভবিষ্যৎ বলতে পারে তোমাদের রব, ঈশ্বর, প্রভু। আমি এসবের কিছুই না। পুষ্পিতা মাথাব্যথা যদি খুব বেশি হয়, মাকে বলো চা করে দিতে। তার সঙ্গে বসে চা খাও, ভালো লাগবে। যেমনটা তুমি করো প্রতিদিন সকালে। প্রতিদিন ঘুম ভেঙে উঠে তুমি যখন মায়ের সঙ্গে বারান্দায় বসে ধোঁয়া ওঠা গুড়ের চা খাও, তোমার তখন নিজেকে পৃথিবীর খুব সুখী একজন মনে হয় না? এই আনন্দটা প্রকাশের মতো না, শুধু মনের ভেতর এক অফুরন্ত প্রশান্তি আর তৃপ্তির আমেজ। কয়জনের এমন ভাগ্য হয়? আচ্ছা পুষ্পিতা, কাল থেকে যদি মায়ের সঙ্গে বসে আর চা না খাওয়া হয়, তুমি কি কষ্ট পাবে? খুব কষ্ট?
ইতি অরিন্দ্রম।’

জানালা দিয়ে শীতের হালকা ঠান্ডা বাতাস আসছে, আকাশটা আজ খালি, না আছে চাঁদ না কোন তারা। পুষ্পিতা সেদিকে তাকিয়ে ভাবছে, এই আকাশের পর কি অন্য কোনো আকাশ আছে? যেখানে গেলে অরিন্দ্রমের চিঠি আর আসবে না!

  • লেখক: কেবিন ক্রু, বেসরকারি এয়ারলাইনস[email protected]