অভিভাবকের নিবিড় পরিচর্যাই পারে কিশোর অপরাধ কমাতে

কিশোর অপরাধ প্রতিটি সমাজের জন্য একটি উদ্বেগজনক সামাজিক সমস্যা, যার প্রভাবে দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। জাতিসংঘ শিশু অধিকার কনভেনশন অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সী সবাইকে শিশু বলে ধরে নেওয়া হয়। অবশ্য বাংলাদেশের শিশু আইন-১৯৭৪ অনুযায়ী, ১৬ বছরের কম বয়সী প্রত্যেকেই শিশু হিসেবে বিবেচিত হয়। বিভিন্ন কারণে যেসব শিশু নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে, তাদের সংশোধনের জন্য একটি বিচারব্যবস্থাও রাষ্ট্র কর্তৃক বলবৎ আছে। এই বিচারব্যবস্থার উদ্দেশ্য সাজা দেওয়া নয়, তাদের আত্মোপলব্ধি সৃষ্টিতে অনুকূল পদক্ষেপ নেওয়া। অর্থাৎ, প্রতিষেধক ব্যবস্থা বলা যেতে পারে। কিন্তু প্রতিষেধকের চেয়ে প্রতিরোধ করা উত্তম নয় কি?

কিশোর অপরাধের কারণ খুঁজতে গেলে অনেক বিষয়ই লক্ষ করা যায়, যা অতীতের সমাজব্যবস্থা থেকেই ধারাবাহিকভাবে আধুনিক সমাজব্যবস্থায় চলমান রয়েছে। যেমন: নৈতিক শিক্ষার অভাব, মা-বাবার কর্মব্যস্ততা, দায়িত্বহীন আচরণ, পারিবারিক অসচ্ছলতা ইত্যাদি। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির এই বিশ্বায়নের যুগে আরও নতুন কিছু কারণ যুক্ত হয়েছে।

যেখানে কিশোরেরা প্রযুক্তির কল্যাণকে কাজে লাগিয়ে নিজের অফুরন্ত সম্ভাবনাকে বিকশিত করবে, তা না করে এর নেতিবাচক দিকগুলো অনুসরণ করে উল্টো দিকে ধাবিত হচ্ছে। কেউ কেউ অনেকটা অনুশীলন ও কৌতূহলবশত সাময়িক আনন্দ বা প্রশান্তির আশায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু এই বয়ঃসন্ধিকালের অপরাধ তাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে, তা নিয়ে ভাবনার বিন্দুমাত্র চেতনাও অন্তরাত্মায় প্রতিফলিত হয় না। একটা সময় অপরাধবোধ মাথায় নিয়েই বাকি জীবনে তাকে লক্ষ্যহীন, বিশৃঙ্খল, ঝামেলাযুক্ত সময় অতিবাহিত করতে হয়, যা তরুণ প্রজন্মের কাছে সমাজ, জাতি, তথা দেশ প্রত্যাশা করে না। এখন প্রশ্ন হলো এর জন্য দায়ী কে? মানুষ কখনো অপরাধী হয়ে জন্মায় না। একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পারিবারিকভাবেই সামাজিকীকরণের আওতায় বড় হতে থাকে। এহেন পরিবারই তার প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শক। আসলে একটি শিশু জন্ম দিলেই পিতা-মাতা দাবি করা যায় না। কেবল তাকে প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তুলেই দাবি করা যায়।

সুইজারল্যান্ডের মনোবিজ্ঞানী জ্যা পিঁয়াজের মতে, ‘শিশুর জ্ঞান বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ হয় এবং জ্ঞানই তার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে।’ তাই তিনি শিশুর জীবনে অর্জিত এই জ্ঞানীয় কাঠামোর কয়েকটি নির্দিষ্ট স্তর নির্ণয় করেছেন। বুদ্ধিমত্তা বিকাশের এসব স্তরের প্রতিটির নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্যও আছে।

তাহলে দেখা যায়, বিদ্যালয়ে ভর্তির আগপর্যন্ত একটি শিশু পারিবারিক অনুশাসন ও শৃঙ্খলার মধ্যে বড় হয়। এ সময় শিশুর আবেগ, ব্যক্তিত্ব এবং অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি বা সম্পর্কের পরিবর্তন ইত্যাদি সামাজিক-আবেগিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। অর্থাৎ এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়, যে স্তরে মূলত একটি অঙ্কুরিত চারার নিবিড় পরিচর্যায় একটি পূর্ণাঙ্গ বৃক্ষের ভিত্তি গড়ে ওঠে। এ সময়টাতে শিশুরা পছন্দনীয় প্রতিটি কাজই করার জোরালো প্রচেষ্টা করে। তাই তার কাজে বাধা দিলে তা না মেনে একঘেয়েমিতা প্রদর্শন করে। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো কোনো কাজ তার জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই দশটি কাজের মধ্যে যে কাজটি শিশুর জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর, ওই একটি কাজের নিষেধ করা প্রয়োজন। আর বাকি নয়টি কাজ তাকে করতে দেওয়া উচিত। অন্যথায়, যদি একসঙ্গে চারটি বা পাঁচটি কাজের নিষেধ দেওয়া হয়, তাহলে সে তা মানবে না। এভাবে পর্যায়ক্রমে একটি একটি করে কাজের নিষেধ দিয়ে বাকি কাজ করতে দিলে সে কখনো একঘেয়েমিতা প্রকাশ করবে না। যেমন ধরা যাক, একটি শিশু বেশির ভাগ সময় ক্রিকেট খেলতে চায়। এটা তার কাছে অনেকটা নেশার মতো। এখন ওই শিশুটিকে যদি বাধা দেওয়া হয়, তাহলে সে একটা সিনক্রিয়েট করে বসবে। তাহলে উপায় কী?

ক্রিকেটের চেয়ে আনন্দদায়ক, যা কম সময়ে শেষ হয় এবং শিক্ষণীয়, এমন একটি গেম তাকে দিলে সে আস্তে আস্তে ক্রিকেটে আর অতটা সময় ব্যয় করবে না। তার মানে ক্রিকেট খেলবে না তা নয়। শিশুর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মুক্ত মাঠে একটা নির্দিষ্ট সময়ে খেলাধুলা অবশ্যই প্রয়োজন। তবে মনে রাখতে হবে, এসব কাজই অভিভাবক হিসেবে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।

এই প্রাক্‌-প্রাথমিক সময়ই হলো একটি শিশুর নৈতিকতা, আদর্শ, সততা তৈরির উপযুক্ত সময়। শিশুকে যদি বলা হয়, ওই যে লোকটি আসছে, এলে বলবে বাবা বাড়িতে নেই। শিশু ঠিকই লোকটিকে বলে দেবে, বাবা বাড়িতে নেই।

কিন্তু পরক্ষণেই শিশুটি ভাবে, বাবা তো বাড়িতেই আছে!

এমন মিথ্যা শেখানো মানেই নিজের সন্তানকে মিথ্যা আশ্রয়ের কৌশল শেখানো। যার ফল হবে তিক্ত, দুর্নীতিগ্রস্ত।

হাতির বাচ্চাকে ছোট থেকেই সামনের একটি পায়ে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয় যেন সে ছুটে দূরে কোথাও যেতে না পারে অথবা কারও ক্ষতি না করে। এভাবে হাতিটি ওই শৃঙ্খলা ও নির্দেশনার মধ্য দিয়ে একসময় অনেক বড় ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ইচ্ছা করলে মুহূর্তেই রশি ছিঁড়ে ফেলতে পারে, এমন বিশাল শক্তি তার আছে, কিন্তু তা করে না। কারণ, সে এভাবে রশি পড়তে অভ্যস্ত, ছিঁড়তে নয়।

তাই সন্তানকে যোগ্য ও বিনয়ী করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। যে সন্তান বড় হয়ে মা–বাবার আদর্শ বুকে লালন করে মানুষ ও দেশের তরে আত্মত্যাগের ব্রত নিয়ে সুসংগঠিত জীবন গড়ে তুলবে। একটি শিশুর অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার জন্য শুধু সমাজ বা অপসংস্কৃতি দায়ী না; প্রথম ও প্রধান দায়ী হচ্ছে অভিভাবক তথা পরিবার। এ জন্য পরিবারের অভিভাবককে হতে হবে বিনয়ী, জ্ঞানী, অভিজ্ঞ, বিচক্ষণ ও দূরদর্শীসম্পন্ন। আর এমন কোনো হীন কাজ করা যাবে না, যার প্রভাব সন্তানের ওপর গিয়ে পড়ে। সন্তানের মনে মা–বাবার প্রতি আস্তে আস্তে ঘৃণার জন্ম হয় এবং শ্রদ্ধাবোধ থেকে সন্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সন্তানকে শিশু বয়সে অস্বাভাবিক গতিতে বাইক চালাতে দেওয়া, পশ্চিমা স্টাইলের চুলের ফ্যাশন, প্রয়োজন ছাড়া দামি মোবাইল, কম্পিউটার কিনে দেওয়া হয়তো সন্তানের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে, কিন্তু তা সমাজ, জাতি, দেশ কিংবা নিজের সন্তানের মারাত্মক ক্ষতির যেন কারণ না হয়, সেদিকে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি ও নির্দেশনা রাখা একান্ত জরুরি।

মানুষ তার সৃষ্টির মধ্যে বেঁচে থাকতে চায়। প্রকৃতির অনুগ্রহে জন্ম নেওয়া সন্তানের মধ্যে বেঁচে থাকতে হলে সুশিক্ষায় তাকে বড় করাটাই বাঞ্ছনীয়। একসময় বটবৃক্ষ হয়ে এই প্রকৃতির বুকেই তৃষ্ণার্ত, ক্লান্ত পথিককে ছায়া দেবে।

সরকার প্রতিটি শিশুর প্রতিই আন্তরিক। তাই তাদের অপরাধের জন্য শাস্তি নয়, সংশোধনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছে; কিন্তু সেটি সংক্রামিত হওয়ার পর। তার চেয়ে যদি সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আগে থেকেই অর্থাৎ প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, তবে দেশ থেকে কিশোর অপরাধ কমে যাবে। কিশোরেরা তাদের উদ্ভাবনী স্বপ্ন জয়ের নেশায় দেশপ্রেমের আদর্শ নিয়ে বড় হবে। একসময় আপনার আজকের শিশুটিই হতে পারে বিশ্বনেতৃত্বের মহানায়ক।

  • শিক্ষক, ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল, গাজীপুর।